• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

অবরোধ ও অর্থনীতি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৩  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতা। নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শাক-সবজি, ফলমূল সবকিছুর দাম বাড়তি। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া বিঘিœত হওয়ায় শিল্পের উৎপাদনসহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি

দেশের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়তে থাকে। এতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। সীমিত আয়ের মানুষদের পারিবারিক খরচের একটা বাজেট থাকে। ধরি একজন গৃহিণীর কাঁচাবাজারের জন্য মাসিক ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ। হঠাৎ লাগাতার অবরোধ কিংবা হরতালের কারণে দাম বাড়ল। সেক্ষেত্রে তাকে যদি বাড়তি ২ হাজার টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে এই চাহিদা পূরণ করতে সেই গৃহিণীকে হয় ঋণ করতে হবে নতুবা অন্যখাতের খরচ কমাতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত। অর্থনীতিতে যেকোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিলে তার প্রভাব সবার আগে এ দুই শ্রেণির ওপর পড়ে। আর এরাই অর্থনীতির মূল স্তম্ভ।

ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের মধ্যে নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকাও কাটছাট করা হচ্ছে। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসছে হরতাল-অবরোধ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতা। নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শাক-সবজি, ফলমূল সবকিছুর দাম বাড়তি। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া বিঘিœত হওয়ায় শিল্পের উৎপাদনসহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমায় চলতি বছরের অক্টোবরে মোট রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অক্টোবরে রপ্তানি আয় এসেছে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের (এক বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার) তুলনায় কম।

রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ নেতৃত্ব দেয়া এ খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিদেশী ক্রেতারাও পণ্য কেনা কমিয়েছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামীতে আরও বাড়বে এ শঙ্কা। এর ফলে বন্ধ হয়ে যাবে অনেক প্রতিষ্ঠান এবং হাজার হাজার শ্রমিক হবেন বেকার। 
বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি যখন চাঙ্গা হচ্ছিল, তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সে যুদ্ধের প্রভাব না কাটাতেই শুরু হলো ইসরাইল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ। যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানিসহ বৈদেশিক লেনদেন নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে খাদ্যমূল্যস্ফীতি একযুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সরবরাহ বাড়ানো এবং রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার দরুন রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স, বিদেশী বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানও কমছে। ক্রমাগত অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিয়মিত হরতাল অবরোধের কারণে খেলাপি ঋণ এবং তারল্য সংকট বাড়বে। নির্বাচন আসন্ন হলেই দেশে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষদের। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে যেভাবে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।

এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে এবং ডলার সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। অর্থনীতির সব খাতেই তৈরি হবে একটা বিরূপ পরিস্থিতি। গত মাসে রপ্তানি কমেছে, আগামীতে আরও কমবে। ফলে নির্বাচনের ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি হয়তো চলতে থাকবে, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণাম হবে ভয়াবহ।’  
২০১৩-১৪ সালে সংসদ নির্বাচন ঘিরে হরতাল ও অবরোধে দেশের উৎপাদনব্যবস্থায় ২২০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। ওই বছরের বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বব্যাংকের ওই সময়ের মূল্যায়ন রিপোর্ট এটি। এবারও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বর্তমান জিডিপি অনুযায়ী যদি ১ শতাংশও ক্ষতি হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৬৭ কোটি টাকার মতো। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে রয়েছে বাংলাদেশ।

এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এলডিসি থেকে উত্তরণও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দেশ অর্থনৈতিক আঘাতে নাজুক হয়ে যাবে। এতে উন্নয়ন-অগ্রগতির অনেক সূচকে ধাক্কা লাগবে। এ জন্য সরকারকে দ্রুত সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেবা খাত। রাজনৈতিক কর্মসূচির দিনগুলোতে সড়ক পরিবহন প্রায় অচল থাকে। নৌ ও রেলপথেও যাত্রী তুলনামূলক কম থাকায় আয় কমে এ খাতে। অন্যদিকে এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতায় হোটেল ও পর্যটন সেবা খাতের আয় বন্ধের পথে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে পরিবহন খাতে মোট ক্ষতি হয়েছে ২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তিনি আরো বলেছেন, হরতাল-অবরোধে ঢাকায় ৬৪টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং ১৫০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০টি বাস এবং চারটি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। প্রতিদিনের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের আয় ধরলে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে স্থিতিশীল পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর