• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

ফুটবলের নতুন তারকা সাগরিকা

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

৮ ফেব্রুয়ারি কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় ভারতের। ম্যাচে আফঈদা, স্বর্ণা, স্বপ্না, পূজা, উমহেলা, ইতি, সাগরিকারা লড়েন বয়সভিত্তিক ফুটবলে সাফ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে। বাংলাদেশ এই ফাইনালে আসে সাগরিকার গোলেই। ফাইনাল নির্ধারণী ম্যাচের ৯১ মিনিটে অধিনায়ক আফঈদার লম্বা থ্রু ধরে দারুণ এক গোল করে দর্শকের চোখে তাক লাগিয়ে দেন সাগরিকা। এই সাগরিকাই প্রথম ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয়েও করেন জোড়া গোল। চার দলের টুর্নামেন্টে চার গোল করে যৌথ সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছেন তিনি। কেবল তা-ই নয়, সবাইকে ছাপিয়ে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও নিজের ঝুলিতে পুরেছেন আগামীর এই তারকা। অথচ তাঁর ফুটবলই খেলার কথা ছিল না। বাবা-মা এক সময় করেছেন মেয়ের ফুটবল খেলার তীব্র বিরোধিতা। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাগরিকার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামে। বাবা লিটন আলী আর মা আনজু বেগম। চা বিক্রি করে সংসার চালানো লিটন আলীর পরিবারে অভাব-অনটন যেন নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে মেয়ে খেলতে চায় ফুটবল। সমাজের কটু কথার ভয়ে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করতেন বাবা। কিন্তু মেয়ের আগ্রহ আর জেদের কাছে হেরে যান লিটন আলী। বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে খেলতে দিতে চাইনি। আমরা যে পরিবার, তাতে ফুটবল খেলা একটা বিলাসিতাই মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আমার একটা শঙ্কা ছিল, ফুটবল খেললে সবাই কী বলবে! মেয়ের তো বিয়ে দিতে হবে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি পুরোপুরি ভুল ছিলাম। মেয়ে এখন শুধু আমাদের নয়, পুরো দেশের। মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে– এই গর্ব কোথায় রাখি!’ ফুটবলের পাঠ রানীশংকৈলের রাঙ্গাটুঙ্গি একাডেমিতে ফুটবলের প্রথম পাঠ নেন সাগরিকা। একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাঙ্গাটুঙ্গি একাডেমি থেকে কয়েকজন মেয়েকে ভর্তি নিতে চেয়েছিল বিকেএসপি। কিন্তু সাগরিকা সেখানে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তাজুল ইসলামই সাগরিকার বিকেএসপিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। সাগরিকা থাকতে না চাওয়ায় গ্রামে নিয়ে আসেন তাজুল ইসলাম। এরপর রাঙ্গাটুঙ্গি থেকেই সাগরিকাকে অন্য নারী ফুটবলারদের সঙ্গে দলে ভেড়ায় মেয়েদের ফুটবল লিগের দল এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বিকেএসপির বয়সভিত্তিক দলে মেয়েদের লিগে সাগরিকা পাল্লা দিয়েছেন দেশের শীর্ষ নারী ফুটবলারদের সঙ্গে। সেবার ২৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন আকলিমা আক্তার। সাগরিকা গোল করেছিলেন ১০টি। এরপরই মেয়েদের ফুটবলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাঁকে নিয়ে আসেন মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলে। যে রটনা সাহস জোগায় বাফুফের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে খেলতে গ্রাম ছাড়ার পর গ্রামবাসী রটিয়ে দেয়, প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে সাগরিকা! এতে একটু নড়েচড়ে বসে পরিবার। তবে এই কটু কথা থেকে সাহস খুঁজে নেয় সাগরিকা। বাবা-মা যেভাবে এলেন ঢাকায় সে যাক, মেয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছে ঢাকায়, অথচ বাবা-মা হয়ে রাঙ্গাটুঙ্গিতে বসে থাকবেন; সে কী করে হয়! পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বাবা-মা কোনোভাবেই বাড়িতে থাকতে পারলেন না। ৭ তারিখ রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থেকে ট্রেনে চড়ে ঢাকায় চলে আসেন। অনেক লম্বা পথ। ট্রেনে বসার জায়গা না পাওয়ায় সেই যাত্রা আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে তাদের কাছে। এর ওপর আনজু বেগম একটু অসুস্থও ছিলেন। এক সহযাত্রীকে অনুরোধ করে চালের বস্তার ওপর একটু বসার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে রক্ষা! অনেক ঝক্কি-ঝামেলা শেষে কমলাপুর স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে এসে বসলেন লিটন আলী ও আনজু বেগম। মায়ের চোখে জল ও একজোড়া বুট ফ্লাডলাইটের আলো আর ক্যামেরার লেন্সে চোখের জল চিকচিক করছিল সাগরিকার বাবা লিটন আলী ও মা আনজু বেগমের। মায়ের চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি। তবে এ কান্না শোকের নয়, মেয়ের অর্জনে আনন্দের। অশ্রুসিক্ত নয়নে আনজু বেগম বলেন, ‘ফুটবল খেলার জন্য আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করেছে, সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়েই সে ফুটবল খেলেছে। তবে তার জেদ ছিল, সে ফুটবলার হবেই। তাকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। আমাদের কাছে একজোড়া বুট চেয়েছিল, বুটের অনেক দাম, তাই তাকে বুটও কিনে দিতে পারিনি।’ আগামীর স্বপ্ন গতি, শটের পাওয়ার ও গোল করার দক্ষতায় অনেকেই তাঁর মধ্যে জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনার ছায়া খুঁজে পাচ্ছেন। দু’জনের পজিশনও প্রায় একই। জুনিয়র সাফের সেরা খেলোয়াড় হয়েও অগ্রজ সাবিনাকে অনেক ওপরেই রাখলেন সাগরিকা, ‘সাবিনা আপুর জায়গায় যেতে পারব না। তারপরও চেষ্টা করব। এই টুর্নামেন্টের আগে আমাকে কেউ চিনত না। এখন অনেকে চেনে। এতে আমার দায়িত্ব যেন আরও বেড়ে গেছে।’ অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার বলেন, ‘সাগরিকা খুবই ভালো খেলোয়াড়। ওর ওপর আমাদের আস্থা ছিল সে গোল করবে, করেছেও এবং আগামীতে সে আরও ভালো করবে নিশ্চয়ই!’

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর