• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

বিএনপির সাবেক সাংসদ শহিদুল নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটিপতি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২১  

জোট সরকারের পাঁচ বছরে বাউফলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এবং বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ শহিদুল আলম তালুকদার। সবেক এই এমপি শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়ার পছনে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য অন্যতম একটি জাদুর কাঠি ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জ্যাষ্ঠতা লংঘন থেকে শুরু করে জুনিয়র প্রভাষক ও শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক, এমনকি অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নিয়েছেন তিনি। ফলে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান সাবেক এমপির অবাধ্য হয়েছেন তাদের হতে হয়েছে লাঞ্ছিত কিংবা মিথ্যা মামলার আসামি। 
জানা গেছে, বাউফলের ১৪টি ইউনিয়নের ১০টি কলেজ, ৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬১টি সিনিয়র দাখিল মাদ্রাসা এবং ১২২টি সরকারি ও ২২টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ২০০১ সালে শহিদুল আলম তালুকদার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার প্রভাব ঘাটিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে ৮টি কলেজ ও ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। এগুলো হল- বাউফল ডিগ্রি কলেজ, কেশবপুর কলেজ, কালিশুরি কলেজ, বগা ডা. ইয়াকুব শরীফ কলেজ, নওমালা আঃ রশিদ খান কলেজ, ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজ, নুরাইপুর কলেজ এবং বাউফল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সভাপতির পদ গ্রহণ করেই সবেক সংসদ সদস্য শহিদুল আলম সরকারি বিধিমালা উপেক্ষা করে প্রতিটি কলেজ ও বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শতাধিক অধক্ষ্য, প্রভাষক, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আতাঁত করে বিভিন্ন মাদ্রাসায় তিন শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেন। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন লাখ টাকা ডোনেশন নেয়ার অভিযোগ রয়েছে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য নির্বাচনে ডিও লেটার প্রদান করেও বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর শিক্ষক-শিক্ষিকা বদলির ব্যাপারে তাকে দিতে হয়েছে মোটা অংকের অর্থ। রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
দলীয় নেতাকর্মী এবং অনুগতদের নিয়োগ দিয়েও রেকর্ড সৃষ্টি করেছে শগিদুল আলম। তার সমর্ধক বাউফল ডিগ্রি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক এটিএম আবদুল লতিফকে জোষ্ঠতা লংঘন করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারি বিধি অনুযায়ী লতিফের অধক্ষ্য পদে আসীন হওয়ার কোন যোগ্যতা নেই বলে জানা যায়। একই কলেজে উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক সায়েমকে গনিত বিষয়ে প্রভাষক ও উপজেলা বিএনপি সভাপতি আবদুল হক মিয়ার ছেলে শফিকুল হক বাদলকে শরীরচর্চা শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কালিশুরি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু জাফরকে সরিয়ে জামাতের রোকন ও প্রভাষক খলিলুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন তিনি। নওমালা কলেজ উপজেলা বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমানকে ব্যবস্থাপনা পদে নিয়োগ দেয়া হয়। একই ভাবে ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন কাজী নাসির উদ্দিনকে ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রি কলেজে তার অনুগত বাউফল কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক মহসিন মিয়াকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগদানের জন্য তিনি ডিও লেটার ইস্যু করেন এমপি থাকা অবস্থায়।
বাউফল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে দ্বন্দ্ব থাকার সুযোগ নিয়ে সেখানকার সভাপতির পদটিও দখল করেন শহিদুল আলম। এর আগে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দলিল উদ্দিনকে তার ইশারায় বরখাস্ত করা হয়। পরে শহিদুল আলম তার অনুগত শিক্ষক আলী আজম খানকে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। কিন্ত ওই বিদ্যালয়ের বিপুল পরিমান বার্ষিক আয় আলী আজমের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ভাগবাটোয়া নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই আলী আজম খানকে কৌশলে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে জোষ্ঠতা লংঘন করে অপর শিক্ষক মফিজুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কালাইয়া রাব্বানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় নওমালা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি নূর মোহাম্মদকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। উপজেলা বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমানের ভাই ও বাউফল আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোশারফ হোসেনকে বিশেষ বিবেচনায় প্রধান শিক্ষকের পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কালাইয়া ইউনিয়ন বিএনপির আহব্বায়ক আলতাফ হোসেনকে জোষ্ঠতা লংঘন করে কালাইয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।
সাবেক এমপি শহিদুল আলমের অপকর্মের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করায় অনেক প্রভাষক ও শিক্ষকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। এদের মধ্যে নুরাইনপুর অগ্রণী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান মিয়া, ভরিপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এআরআইএম কামরুজ্জামান, দাশপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথ, কালাইয়া ইদ্রিছ মোল্লা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এটিএম মিজানুর রহমান, ধুলিয়া কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক দলিল উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে তিনি কয়েকজনকে নিজ হাতে লাঞ্ছিত করেছেন। চাপের মুখে মঞ্জুর মোর্শেদ, অধ্যক্ষ মিজানুর দলিল উদ্দিনকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন সাবেক এই এমপি। অপরদিকে ছয় হিসা দাখিল মাদ্রাসার সুপার আবদুর রব ও বিলবিলাশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়।
নির্যাতিত এই শিক্ষকরা এখনও প্রাণভয়ে কিংবা চাকরি হারানোর আশংকায় শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে সাবেক এমপি কোটি কোটি টাকা আয় করলেও চাকরির আশায় নিঃস্ব হয়েছে অসংখ্য পরিবার। অভিযোগ রয়েছে, একটি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে সাবেক এমপি শহিদুল আলম একাধিক প্রার্থীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন। প্রার্থীর কাছ থেকে সরাসরি কিংবা তার পোষ্য দালালের মাধ্যমে ওই অর্থ আদায় করতেন তিনি। চাকরি পাওয়ার আশায় অনেক প্রার্থী মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এমপির হাতে তুলে দেন। এদের অনেকেই এখন সুদের বেড়াজালে আটকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর