• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

৮ ডিসেম্বর মেলান্দহ মুক্ত দিবস

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৮ ডিসেম্বর ২০১৯  

কমান্ডার আব্দুল করিম; উমির উদ্দিন পাইলট হাই স্কুল মাঠে প্রথম পতাকা উত্তোলনের মাধ্যদিয়ে মেলান্দহকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন

কমান্ডার আব্দুল করিম; উমির উদ্দিন পাইলট হাই স্কুল মাঠে প্রথম পতাকা উত্তোলনের মাধ্যদিয়ে মেলান্দহকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন

৮ ডিসেম্বর জামালপুরের মেলান্দহ হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১’র এই দিন বিকেলে আলম কোম্পানীর টু-আইসি (পরবর্তীতে সেঙ্গাপাড়া কোম্পানী) কমান্ডার আব্দুল করিম; উমির উদ্দিন পাইলট হাই স্কুল মাঠে প্রথম পতাকা উত্তোলনের মাধ্যদিয়ে মেলান্দহকে শত্রæমুক্ত ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আলহাজ এস.এম. আব্দুল মান্নান ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের প্রবর্তন করেন।    ৭১’র এই দিনে তৎকালীন মেলান্দহ থানার ওসি জোনাব আলীর সঙ্গীয় ফোর্স, আব্দুল হক আকন্দ, নুরুর রহমান সরকার, গিয়াস উদ্দিন, আব্দুল­াহ মৌলানা, আব্দুল গেনা, করিম ভেদা, আব্দুল লতিফ, মোহাম্মদ আলী, শমসের আলী, শহিদুল­াহ, হাশেম, পিস্তলসহ মোট ৪৬জন রাজাকার আত্মসমর্পন করে।    বীরমুক্তিযোদ্ধা কুলিয়ার মরহুম আব্দুল জলিল, বালুআটার মজিবুর রহমান হেলাল, মালঞ্চ’র মোহাম্মদ আলী মিয়ার উদ্দিন, আব্দুর রহিম, আব্দুল জলিল, গিয়াস উদ্দিন, আজিজুল হক পুলিশ, রোকনাইয়ের আব্দুর রহিম, আব্দুর রশিদ মেম্বার, দুরমুঠের আবুল মনসুর, নাংলার ইউসুফ আলী, আ: রাজ্জাক, তেঘরিয়ার মাহবুবুর রহমান, আব্দুল আজিজ, দেওলাবাড়ির আব্দুর রহিম, রোকনাইয়ের রেজাউল করিম, শহিদ আব্দুল কদ্দুস, তৈয়বুর রহমান, ইসলামপুরের আসর উদ্দিন, রেজাউল করিম, মাদারগঞ্জের আবু বকর, সালাউদ্দিন, এডভোকেট গোলাম নবী, রেজাউল করিম, মহিষবাথানের আ:সোবহান, ভাঙ্গুনী ডাঙ্গার আবু সাইদ মাষ্টার, মহিরামকুলের ইসহাক, আব্দুল জলিল, চরগোবিন্দির হাজী আব্দুল খালেক, আদ্রার গোলাম মোস্তফা, জয়নাল আবেদিন, ঢালুয়াবাড়ির আবেদ আলী, বেলতৈলের কামাল হোসেন ছাড়াও নান্দিনা, শেরপুর ও গফরগাঁও এলাকার নাম অজানা প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা এসময় উপস্থিত ছিলেন।    মেলান্দহে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দু’টি সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। একটি হলো মেলান্দহ সদর। অপরটি হলো মাহমুদপুর পয়লা ব্রিজ। মাহমুদপুর যুদ্ধক্ষেত্রে করিমের সহযোদ্ধা ইউসুফ আলীর ব্রাশ ফায়ারে ১২জন পাক সেনা নিহত হয়। এসময় তেঘরিয়া-সিরিঘাট এলাকার রমিজ, নাম অজানা আরেক মুক্তিসেনাসহ ৮/১০জন বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। অপর সহযোদ্ধা কলাবাধা হাই স্কুলের ছাত্র আব্দুল কদ্দুস পাকবাহিনীর হাতে আটক হন। পাকবাহিনীরা কদ্দুসকে ইসলামপুরে নিয়ে জুতোর মালা পরিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিতে বাধ্য করে। নির্মম নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে জামালপুর কালিরঘাটে হত্যা করে। আদিপৈতের সমর পাকসেনার হাতে বন্দি হন। তাঁকে নির্মম নির্যাতনের মধ্যদিয়ে হত্যা করা হয়। অসংখ্য বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় পাক সেনারা। এখবরটি তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে স¤প্রচারিত হয়।   যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন তারা হলেন- কোনামালঞ্চ’র আমানুল­াহ কবির, আদিপৈতের সমর উদ্দিন, শাহাজাদপুরের নুরুল ইসলাম, চরগোবিন্দির শাহজাহান, রোকনাইয়ের আব্দুল কদ্দুস, বীর ঘোষেরপাড়ার জয়েন উদ্দিন এবং কাহেতপাড়ার নুরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধা ও মেলান্দহবাসির প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানাযায়-তৎকালীন ঝুপড়ি এলাকা-বর্তমান মেলান্দহ উপজেলা পরিষদ চত্বরের মধ্যে (গণকবর বা বধ্যভূমি) এক নিচু জায়গায় অনেক লোককে নির্যাতন শেষে হত্যা করতো পাকবাহিনীরা। নিহতদের তালিকায় রয়েছেন-শাহজাতপুরের আব্দুল বারেক, দিঘলবাড়ির বাচ্চু মিয়া, বারই পাড়ার গৌর গোপাল, আদিপৈতের গোপাল ডাক্তার, কাজিরপাড়ার লুৎফর রহমান লেবুসহ নাম অজানা অনেকের নাম বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য।   ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেলান্দহ সীমান্তে ৩টি হানাদার ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প ৩টি জামালপুর-মেলান্দহ সীমান্তে ঝিনাই ব্রিজ, নলেরচর, বেতমারী, সাধুপুর, বানিপাকুরিয়া ও দাগী এলাকার ৭ ও ৮নং রেলওয়ে ব্রিজ। পাকবাহিনীর ক্যাম্পদ্বয় বানিপাকুরিয়া গ্রামের সাথে অবস্থিত থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু সবচে’ বেশী মানুষ নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছে। এদের মধ্যে দাগী গ্রামের নবীন মোল­া মটর পাগলা, দু’সহোদর, আনোয়ার হোসেন আনার পাগলা, আ: আজিজ, বেতমারী গ্রামের নজি মেম্বার, বানিপাকুরিয়ার অছিমদ্দিন, দু’সহোদর ওমর আলী, সৈবালি, কারী আ:ওয়াহাব, নিহন আলী, ডা: আব্দুস সামাদ মন্ডলসহ অনেক লোকদের ক্যাম্পে (টর্চার সেলে) নিয়ে নির্যাতন করে। যুদ্ধচলাকালে পাকবাহিনীরা শিশু শাহ্ জামালকে মায়ের কুল থেকে কেড়ে ক্যাম্পে নিয়ে পাথরে নিক্ষেপ করে। জালাল উদ্দিন নামের এক দিন মজুর ওই শিশুকে উদ্বার করে মায়ের বুকে পৌঁছে দেন। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে শিশুর দাদী-বোন মারা গেছেন।    বানিপাকুরিয়া গ্রামের আ: সামাদ ডাক্তারসহ অনেকের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ায়। মালঞ্চ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা (হানাদারমুক্ত ঘোষক) আ: করিমের বাড়িও পুড়ে দিয়ে তাঁর পিতা জমশের মন্ডলকে ধরে নিয়ে যায় পাকসেনারা। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিসেনাসহ সাধারণ লোকদের ধরে নিয়ে এই রেলওয়ে ব্রিজ ক্যাম্পে নির্যাতনসহ বহুলোকদের হত্যা করা হয়।    ওদিকে শিশুর পিতা ওমর আলী, চাচা শৈবালি দু’সহোদর সকাল বেলা কাঁচি হাতে মাঠে কাজের জন্য বের হন। এসময় রেলওয়ে ব্রিজের ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা দুই ভাইকে মুক্তিযোদ্ধার গুপ্তচর ভেবে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। দাগি রেলওয়ে ব্রিজ ক্যাম্প থেকে ভ্রাতাদ্বয়কে একটি কয়লা ইঞ্জিনে তুলে দেওয়ানগঞ্জে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর তাদের সামনেই জ্বলন্ত কয়লা ইঞ্জিনে জীবন্ত এক লোককে আগুনে পুড়ে মারা হয়। তাদেরও আগুনে পুড়ে মারার ঘোষণা দেয়া হয়। জীবন্ত মানুষ পুড়ে মারার দৃশ্য দেখে ছোটভাই শৈবালি অজ্ঞান অবস্থায় পায়খানা-প্র¯্রাব করে বেসামাল হন। কয়লা ইঞ্জিনের ড্রাইভার সহোদর ভ্রাতার পরিচয় জেনে ভ্রাতাদ্বয়কে পালানোর সুযোগ করে দেন। ভ্রাতাদ্বয় বাড়িতে আসার পর জানতে পারেন-মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে বাতাস ভারী করে তোলে। পরে জানাগেছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ব্যক্তিই ছিলেন-মুক্তিযোদ্ধা তুফানু।   জামালপুর যুদ্ধের প্রথম অভিযানটি ছিল মেলান্দহ উপজেলার দাগি-বানিপাকুরিয়া রেলওয়ে ব্রিজে পাকসেনাদের ক্যাম্প ধ্বংশ করেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল গ্রুপ। ব্রিজ ভাঙ্গার পর এলাকায় অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।    ২৫জুন/৭১ মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, মজিবর ফারাজী, রইচ ও হাসেন জামালপুর চন্দ্রার আলম, দিগপাইতের রইচ উদ্দিন, ইসলামপুরের মানিকুল ইসলাম মানিক বর্তমানে কমান্ডার, মাদারগঞ্জের হাছেন আলী, মেলান্দহ ঘোষেরপাড়ার আসাদুল্লাহ কমান্ডার, শাহাজাতপুরের মজিবুর ফারজী। তাদের গ্রæপ লিডার ছিলেন-আলম, মানিক ও রইচ। তৎকালীণ আ’লীগের সেক্রেটারী মালঞ্চ নয়াপাড়ার আলহাজ রুস্তম আলী ঠিকাদার শলাপরামর্শক। রুস্তম কন্ট্রাক্টরের দিক নির্দেশনায় আবুল, আলম ও মজিবর ফারাজী ছদ্মবেশে ব্রিজের উত্তরে ঘুন্টিঘরের পাশে একটি বৃহত জামগাছে ওঠে চারদিক রেখি করেন। ২৭জুন/৭১ রাতে বোমা পুঁতে ক্যাম্পে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। জামালপুরের মধ্যে প্রথম অভিযান হিসেবে বিবিসি-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচার হয়েছে।    পতাকা উত্তোলনকারী আ: করিম জানান- ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আ: করিমের নেতৃত্বে মেলান্দহ থানামুক্ত করার জন্য ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ফায়ার করে থানা ঘিরে ফেলেন। এসময় রাজাকারদের আত্মীয়-স্বজনরা (মোজাম্মেল বদরের ভাই, নুর মাহমুদ সরকার বদর কমান্ডারের ছেলেরা), তৎকালীন ওসি জোনাব আলী, আত্মসমপর্নের প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাব পেয়ে ৩০ মিনিট সময় বেঁধে সকল অস্ত্র থানার মাঠে সাজিয়ে মেলান্দহ উমির উদ্দিন পাইলট হাইস্কুল মাঠে সবাইকে  নিয়ে আসতে বলা হয়।    ওসি জোনাব আলীসহ ৪০/৪৬ জন রাজাকার আলবদর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে।    ৮ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে আ: করিম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন পূর্বক মেলান্দহকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন। ওইদিন হাজার হাজার জনতার হাতে রাজাকারদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বিক্ষুব্দ জনতা রাজাকারদের উত্তম-মাধ্যম দিয়ে তাড়িয়ে দেন।    মেলান্দহ মুক্ত করার পিছে তৎকালীন মেলান্দহ বাজারের ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন জামালী, বাসুদেবপুরের আফাজ উদ্দিন বি.কম, আ: খালেক মোল­া (আদ্রা), মালঞ্চ’র আ: মজিদ সাবেক চেয়ারম্যানসহ আরো কয়েক জনের সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল।    সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্বা সংসদের কমান্ডার সরকার আব্দুস সালাম বকুল জানান-৭১ সালে বহু মুক্তিযোদ্ধার বাড়িঘর পুড়ে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ এ সকল বাড়িপোড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পূণর্বাসনে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। রাজনৈতিক যাঁতাকলে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পথ বন্ধ করা এখন সময়ের দাবী।    এই দিনে জাতী-ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল শহিদ পরিবারকে সমবেদনা, মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিকামী জনতা এবং শত্র“মুক্ত দিবসে অংশ গ্রহণকারী সবাইকে মেলান্দহবাসির বিজয় শুভেচ্ছা।    বিজয়ের মাস জুড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। মুক্তিকামী জনতা ও সচেতন মহল মনে করেন-ঝিনাই ব্রিজ থেকে মালঞ্চ পর্যন্ত রাস্তাটি মেলান্দহকে হানাদারমুক্ত ঘোষণাকারী আ: করিম সড়কের নাম করণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি উজ্জীবিত করা হোক। সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য/স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে। মেলান্দহ উপজেলায় তা নেই। কাজেই এ বিষয়টির প্রতি কর্তৃপক্ষকে নজর দেবার প্রয়োজন।  ৮ডিসেম্বরে পতাকা উত্তোনকারী আ: করিম ও দিবসটির প্রবর্তক সাবেক কমান্ডার আলহাজ এসএম আ: মান্নানের প্রতি কৃতজ্ঞতা-শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মেলান্দহবাসীর। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক ও ইউএনও তামিম আল ইয়ামীন জানান-স্থানীয়ভাবে এই দিবসটি উদযাপনের প্রস্তুতি নিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।    লেখক- শাহ জামাল সেবা হট নিউজ সংবাদদাতা মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি,  মেলান্দহ রিপোর্টার্স ই্উনিটি, জামালপুর। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর