• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

হুন্ডির আদ্যোপান্ত

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৩  

বাংলাদেশের অর্থনীতি সর্বগ্রাসী হুন্ডির কবলে পড়েছে। শত চেষ্টা করেও এই অর্থনীতি খেকো হুন্ডির গায়ে না লাগে বিষাক্ত তীর বা না লাগে বন্ধুকের গুলি। অনবরত গিলছে তো গিলছেই। এতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হয়েও কোনো কিছু করতে পারছে না। কারণ এর ভিত বড় শক্ত এবং শেকড় বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। হুন্ডি বলতে সাধারণত নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে কিংবা অননুমোদিত চ্যানেলে বিভিন্ন কৌশল ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, এক স্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ আনয়ন বা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। হুন্ডি হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা মধ্যযুগীয় ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য ও ঋণ লেনদেনে ব্যবহারের জন্য উদ্ভূত হয়েছিল।

সাধারণত হুন্ডি এক স্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ প্রেরণের জন্য রেমিটেন্স পদ্ধতির একটি মাধ্যম, যা ক্রেডিট উপকরণ হিসেবে অর্থ দেনা-পাওনা বা বাণিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে বিনিময় বিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা হয়। আসলে এটির মাধ্যমে দুইপক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। হুন্ডির কার্যক্রম প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। একটা সময়ে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ। এখনো তা নিরাপদ, তবে বৈধ না। অষ্টম শতাব্দীতে চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সিল্ক রুটে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। ডাকাতির ভয়ে তখন নগদ অর্থ বা মূল্যবান কিছু বহন করা নিরাপদ ছিল না। আর সেই সময় থেকেই হুন্ডির প্রসার।

বস্তুত হুন্ডি বা হাওয়ালা একই প্রপঞ্চ। হাওয়ালা কথাটা এসেছে আরবি থেকে। আর হুন্ডি এসেছে সংস্কৃতি হুন্ড শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো সংগ্রহ করা। হুন্ডি কথাটি আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়। আর মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাতে হাওয়ালা কথাটা প্রচলিত এবং এর অর্থ হচ্ছে লেনদেন বা কোনো কিছু পাঠানো। হুন্ডি অনেক প্রকারের। তবে বহুল ব্যবহৃত হুন্ডি দুই প্রকারের; যেমনÑ (র) দর্শনি হুন্ডি এবং (রর) মুদ্দাতি হুন্ডি। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, দর্শনি হুন্ডি দৃশ্যমান, যা সচরাচর চোখে পড়ে এবং এটি প্রাপ্তির পরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থ প্রদান করতে হয়, যা চাহিদা বিলের অনুরূপ। অন্যদিকে মুদ্দাতি হুন্ডি টাইম বিলের মতো একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে দিতে হয়। 
এক সময়ে হুন্ডি ছিল বৈধ ও নিরাপদ। এখন তা নিরাপদ তবে বৈধ নয়। এর সপক্ষে একটি গল্প মনে পড়ে যায়। তবে গল্পটি সত্য কি মিথ্যা, তা জানি না। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে জনৈক বন্ধু বলেছিল যে কোনো একটি সরকারি সংস্থার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি প্রায় দুই কোটি টাকা অবৈধ পথে অর্জন করেন। কিন্তু এই কালো টাকা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লে তারই একজন বন্ধুর পরামর্শে তার (সভাপতি) যে ছেলে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিল। সেই ছেলের নিকট হুন্ডি মারফত ওই অর্থ পাঠায়।

পরে ছেলের প্রবাসী আয় দেখিয়ে হুন্ডি মারফত ফেরত এনে সেই টাকা হোয়াইট বা হালাল করেন। এই ধরনের ঘটনা নাকি চক্ষুর আড়ালে অহরহ হচ্ছে। আসলে আগে হুন্ডির কার্যক্রম তখনকার সময়ের উপযোগী হলেও এখন খারাপের দিকটাই বেশি। তাই হুন্ডি ব্যবসা কোনো দেশেই ভালো চোখে দেখে না। কোনো এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশে প্রবাসী আয় আনুষ্ঠানিক বা অফিসিয়াল চ্যানেলে আসে ৫১ শতাংশ, আর হুন্ডিতে ৪৯ শতাংশ। 
হুন্ডি কার্যক্রম উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তার পেছনে উল্লেখ্য, প্রবাসীরা ডলারের বেশি দর পেতে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী বলে হুন্ডির চাহিদা তথা পরিমাণ বাড়ছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলেন- দেশে ডলারের চাহিদা বেশি হলে হুন্ডিওয়ালারা এ সুযোগ নিয়ে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, অর্থ পাচার একটি অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এর মধ্যে লাখো কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথিতযশা এক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এই উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি আরও বেগবান হতো, যদি অর্থ বা পুঁজি পাচার না হতো। আর পাচারের দিক দিয়ে প্রায় অর্থনীতিবিদ হুন্ডিকে দায়ী করেন। তবে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তার চেয়ে ১০ গুণ হয় বাণিজ্যের আড়ালে (ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং)। 
বর্তমান হুন্ডি ব্যবসা রমরমা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বিশ^ব্যাংকের সাউথ এশিয়া বিভাগের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জো লিউ শি এবং পরামর্শক শিয়াও জু লিখেছেন যে, সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ঠিক রাখতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু এতে উল্টো ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলে সংকট আরও বাড়ছে। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন যে সরকার যখন বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। তখন হুন্ডির চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।

বিশেষ করে, আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খুলতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলে ছোট ছোট আমদানিকারকরা হুন্ডির ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তখন বেশি দরে ডলার ক্রয়ের কারণে হুন্ডির লেনদেনের পথ সুগম করে থাকে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারর্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ (এবিবি) কর্র্তৃক ডলারের হার নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই নির্ধারিত ডলারের হারের চেয়ে বাজারে ডলারের দাম বেশি বলে হুন্ডির কার্যক্রম তৎপর হয়ে উঠেছে। যদিও অনেক ব্যাংক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বেশি দামে ডলার কিনছে।

কেননা নির্ধারিত রেটে ডলার কিনতে গেলে বাজারে অধিক দাম থাকায় রেমিটেন্স ডলার কেনা সম্ভব হয় না। তখন ওগুলো হুন্ডিওয়ালার কবজায় চলে যায়। এক্ষেত্রে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও সমন্বয়হীনতা আরও তালমাতাল করে তুলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, যতগুলো কারণে রিজার্ভের উপর চাপ পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো হুন্ডির তেলেসমাতি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য, চলতি মাসের ৮ তারিখ সংবাদ মাধ্যমে জানলাম, রিজার্ভ নাকি ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
বস্তুত মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা আর্থিক প্রণোদনা প্রবাসী আয়কে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা দেশীয় মুদ্রা যদি দুর্বল অবস্থায় থাকে। সেক্ষেত্রে প্রবাসী আয় পাঠাতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হলেও স্বল্প মেয়াদে প্রবাসীদের কাছে সরকারি হার আকর্ষণীয় হতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে যতক্ষণ না পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতা ঠিক না রাখা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ হুন্ডির দিকে ঝুঁকে থাকবে।

ইতোমধ্যে প্রণোদনা দিয়ে ও টাকার বড় অবমূল্যায়ন করেও প্রবাসী আয়কে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তাই এর জন্য সবার আগে পুরো আর্থিক খাতকেই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ এবং অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। আসলে এই সমস্যাটি ক্যান্সারের মতো জটিল এবং সহজে সমাধা করা দুরূহ ব্যাপার। এদিকে মানি লন্ডারিং আইন মোতাবেক সঠিক ডকুমেন্টসবিহীন লেনদেন দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু অবস্থাভেদে প্রতীয়মান হয় যে, আইন করে বা পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে হুন্ডি বন্ধ করা অলীক কল্পনা মাত্র।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কার্ভ নি¤œমুখী। এদিকে মানি মার্কেটসহ খোলাবাজারে চলছে ডলারের তীব্র সংকট। যেভাবেই বলি না কেন, রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রবাসী আয়। অথচ হুন্ডিই হলো এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে যাই হোক না কেন, বর্তমানে হুন্ডি নৈতিকতাবর্জিত ব্যবসা। এটি প্রকারান্তরে ইসলামও স্বীকৃতি দেয় না। বাস্তবে দেখা যায় যে, উন্নয়নশীল তথা মধ্যম আয়ের দেশে হুন্ডির নেতিবাচক কার্যক্রম ঠেকানো মুশকিল। আবার সামনে জাতীয় নির্বাচন।

আর এই নির্বাচনের সময়ে সাধারণত দেখা যায়, পাচার তুলনামূলক বেড়ে যায়। যা হোক, পরিশেষে বলতে চাই যে, হুন্ডির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অপকা- ঠেকাতে মানি মার্কেটসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নড়ে চড়ে বসতে হবে। নতুবা অর্থনীতি খেকো হুন্ডি রোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর