• রোববার ০৫ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

প্রস্তুতি ছাড়াই অংশগ্রহণ বই নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৩  

ইউরোপের দেশ জার্মানিতে শুরু হওয়া বইমেলা এখন মাঝামাঝি সময় পার করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বই মেলা ঘিরে উৎসবমুখর ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরী। নানা দেশের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা এতে যোগ দিয়েছেন। তবে এই মেলাটি মূলত প্রকাশকদের। আয়োজক এবং অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশটি প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বইয়ের স্বত্বসহ বিচিত্র কন্টেন্ট ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে এখানে। সে লক্ষ্যে যে যার জায়গা থেকে নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশের বেলায় ঘটছে উল্টোটি। মেলায় বহু বছর ধরে অংশগ্রহণ করলেও, দৈন্যদশা কাটেনি। এখনো এলোমেলো। অগোছালো। অপ্রস্তুত। একটা দায়সারা গোছের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত কয়েকদিন বাংলাদেশের স্টলে গিয়ে দেখা যায়, কোনো প্রকাশক নেই সেখানে। প্রকাশকদের এজেন্ট বা প্রতিনিধি নেই।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মেলয় অংশ নিয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশ করে না। তবে কিছু কিছু মেলার আয়োজন করে থাকে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। বই মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর। তার সঙ্গে এসেছেন মন্ত্রণালয়ের আরও দুই কর্মকর্তা। এর বাইরে জার্মানিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তা স্টলে কাজ করছেন। তবে মিনার মনসুর ছাড়া কেউই বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। এ কারণে বই বা বাংলাদেশকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা তারা রাখতে পারছেন না। কারণ ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলায় বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতে হয়। কোন বইয়ের কি গুরুত্ব তা ক্লায়েন্টদের কাছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হয়।

এই কাজটি বাংলাদেশের স্টলে হচ্ছে না বলে স্বীকার করে নিয়েছেন মিনার মনসুর নিজেও। তিনি বলেন, প্রকাশকদের আমরা মেলায় অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। উৎসাহ যুগিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ আসতে আগ্রহ দেখাননি। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু স্টলে আসেননি। এসে বসলে তার বই নিয়ে আগ্রহীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। প্রকাশকদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি ও নানা দ্বন্দ্ব আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটাও একটা সমস্যা হয়েছে আমাদের জন্য। 
বাংলাদেশের স্টলে রাখা বইয়ের সংখ্যা অল্প ॥ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় দেশে। কিন্তু  আন্তর্জাতিক বাজারে হাতেগোনা কিছু বই প্রদর্শিত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত বই রাখা হয়েছে স্টলে। এর বাইরে রাখা হয়েছে কিছু সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত আলোচিত বইগুলো আছে। কিছু বই আবার পুরনো। পুরনো বলতে, দুর্লভ বা অ্যান্টিক বুক নয়। বাজারে এ বইগুলোর নতুন কপি পাওয়া যায়। তারপরও মেলায় নিয়ে আসা হয়েছে পুরনো কপি। ফলে হাতে নেওয়ার সময় অতো আগ্রহ কাজ করে না। গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর বলছেন, সরকারিভাবে করা নির্বাচিত বইয়ের একটি তালিকা অনুসারে এসব বই আনা হয়েছে। কিন্তু এসব বই নিয়ে কতটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশীরা?

অন্যান্য দেশের স্টলগুলোতে নিজেদের প্রকাশনা স্বত্ব বিক্রি করার লক্ষ্যে একটার পর একটা বৈঠক হচ্ছে। বাংলাদেশের স্টলে তেমন কিছু দেখছি না। কেন? এমন প্রশ্নে গ্র্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক বলেন, বিভিন্ন সময়ে কিন্তু বিদেশীরা আমাদের স্টলে আসছেন। তাদের সঙ্গে আমি আমাদের বই দেখিয়ে কথা বলছি। অনেকে আমাদের বই নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। দেশ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমার তো লোকের অভাব। তাছাড়া ভালো বই থাকলে এমনিতেই লোকজন আসে। আন্তর্জাতিকবাজার ধরার মতো বই তো আমাদের নেই। তারপরও বাংলাদেশের নামটা এখানে থাকুক, একদিন নিশ্চয়ই হবে, তাই স্টলে শ্রম দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে, মেলার প্রথমদিন বাংলাদেশের স্টল চালু না হওয়ার যে তথ্য জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দেশীয় প্রকাশক লেখক সাহিত্যিকরা। অনেকে দেশ থেকে এই প্রতিবেদকের কাছে ফোন করে আরও বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। ক্ষোভ  প্রকাশ করেছেন তারা। শুরুর একদিন আগে গত ১৭ অক্টোবর গোটা মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব দেশের স্টল ও প্যাভিলিয়ন  প্রস্তুত। বিশাল বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ ও সাজানো গোছানোর কাজ আগেই শেষ হয়েছিল। তারপর চলছিল বই ওঠানোর কাজ। কোনো কোনো স্টল দেখে মনে হচ্ছিল মেলা এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু একই সময় বাংলাদেশের স্টলে গিয়ে কোনো প্রস্তুতি চোখে পড়েনি।

তবে বিকেলে অন্য একটি ভেন্যুতে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুরসহ বাংলাদেশ থেকে আগত ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা। পরেরদিন ১৮ অক্টোবর মেলা শুরু হয়। ওইদিন  সকাল থেকেই জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা। কিন্তু বাংলাদেশের স্টলটি সেদিনও ন্যাংটো অবস্থায় পড়ে ছিল। মেলার অন্যান্য আয়োজন ঘুরে দেখে বাংলাদেশের স্টলের সামনে যেতেই চোখ কপালে উঠে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় স্টেনলেস স্টিলের যে কাঠামোটি আয়োজকরা তৈরি করে রেখেছিলেন, সেটি ছাড়া আর কিছু নেই। পাশেই অবস্থিত সিঙ্গাপুর ভারত চীনসহ অন্যান্য এশীয় দেশের স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে তখন পুরোদমে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। স্বত্ব বিক্রি ও কেনার উদ্দেশ্য একের পর এক মিটিং চলছিল স্টলগুলোতে। বাংলাদেশের স্টলে এমন কদাকার চেহারা মেলার সৌন্দর্যও অনেকাংশে নষ্ট করছিল। দেশীয় প্রকাশকরা এ ঘটনাকে দায়িত্বহীনতা ও রুচিহীনতার নজির হিসেবে দেখছেন। 
স্টলে সীমাবদ্ধতা ॥ এখানেই শেষ নয়, মেলার মূল আয়োজকরাও বাংলাদেশের স্টলের কিছু সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মেলার ভাইস প্রেসিডেন্ট মারিফে বোক্স গ্রসিয়া জনকণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের স্টলটি হওয়া উচিত ছিল সেখানে, যেখানে অন্যান্য সব দেশের সরকারের পক্ষ থেকে স্টল বা প্যাভিলিয়ন নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের স্টলগুলোকে আমরা এক জায়গায় আনতে পেরেছি। কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে নেই। এক জায়গায় থাকলে ভালো হতো। আর মেলায় মূলত তারাই আসবেন যারা বই প্রকাশ করেন। বই লিখেন অথবা বইয়ের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট যারা তারা এলে তাদের আসার উদ্দেশ্যটা আসলে সফল হতে পারে।

নিয়ম অনুযায়ী, গ্রন্থকেন্দ্র হবে মূল এক্সিবিটর। তার অধীনে প্রকাশকরা হবেন কো-এক্সিবিটর। এভাবে একই স্থানে পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল বই পাওয়া যাবে, যেটা এবার হয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের কোনো ক্যাটালগিং করা হয়নি। বাংলাদেশ চাইলে তাদের স্ট্যান্ডে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান করতে পারত। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য উদ্যোগ নিতে পারত। সেগুলো তারা ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভেবে দেখতে পারে। তিনি বলেন, বই মেলায় প্রকাশকদের আসা উচিত। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র প্রকাশকদের নিয়ে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পারে। অথবা তাদের বই এখানে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারে। 
অবশ্য মেলার তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে এসে কার্যক্রম কিছুটা জোরদার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর