• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

প্রত্যয়ী কামরুন্নাহার লিপি দর্জি থেকে গার্মেন্টস মালিক

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২  

জীবনের শুরুতেই বড় বাধা
অনন্তপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক আলী উসমানের মেয়ে কামরুন্নাহার লিপি। যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ১ম বর্ষে পড়েন, তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে ১৬ বছর। ওই বয়সেই বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু তখন সংসার পরিচালনার মতো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান-বুদ্ধির কিছুই ছিল না তার। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয় তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, একসময় সংসার ছাড়তে বাধ্য হন।


তালাকপ্রাপ্তা হয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। এ কারণে আর দশটা নারীর মতো তাকেও শিকার হতে হয় নানা রকম অবজ্ঞা-অবহেলার। শুনতে হয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের কটু কথা। আর এমন পরিস্থিতির মধ্যেই খুঁজতে থাকেন ঘুরে দাঁড়ানোর পথ।

জীবনযুদ্ধের শুরু যেভাবে
বাবা-মার বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে কামরুন্নাহার লিপির। ২০০২ সালে তিনি যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু পুঁজি না থাকায় কোনো কাজ করতে পারছিলেন না।

শুরু করলেন দর্জির কাজ
একদিন লিপির সহকর্মী (বর্তমানে তার স্বামী) সোহেল একজনের কাছ থেকে ধার করে এনে একটি সেলাইমেশিন দেন। এটি পাওয়ার পর ফুটপাথের কয়েক দোকানির সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাদের পরামর্শে দর্জির দোকান থেকে পরিত্যক্ত টুকরো কাপড় কিনে এনে বানাতে শুরু করেন শিশুদের নিমা, ফতোয়া, প্যান্ট ইত্যাদি। বানানোর পর সেগুলো আবার ফুটপাথের দোকানিদের কাছে পাইকারি বেচতেন। ওই কাজ করতে গিয়ে জেলা শহরের চকপাড়া এলাকার মোল্লা মিয়া নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়।


তিনি শিশুদের ড্রেস বানাতেন। মোল্লা মিয়া লিপিকে প্রতিদিন ১০০ পিস ইজার প্যান্ট সেলাইয়ের কাজ দেন। প্রতিটি প্যান্ট সেলাইয়ের মজুরি হিসেবে লিপি পেতেন মাত্র ২টাকা। তা থেকে সারাদিনে আয় হতো মাত্র ২০০ টাকা। খরচ বাদে লাভের পুরোটাই সঞ্চয় করতে থাকেন। কিছুদিন পর সঞ্চয়ের টাকায় কিনে আনেন দুটি সেলাই মেশিন।

দর্জি থেকে গার্মেন্টস কারখানার মালিক
২০১৪ সালের দিকে এসে কামরুন্নাহার লিপির হাতে একটা ছোটখাটো তহবিল দাঁড়িয়ে যায়। তখন টিস্যুব্যাগ তৈরির পাশাপাশি আরও যুগোপযোগী কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। তাই আবারও ৭ শতক জমির ওপর ৩২ লাখ টাকায় একটি বিল্ডিং ঘর নির্মাণ করেন কারখানার জন্য। এ পর্যায়ে কারখানায় শুরু করেন জিন্স প্যান্ট, গেবাডিনের প্যান্ট, টিশার্ট ও ট্রাউজার তৈরির কাজ। কিন্তু এলাকায় দক্ষ শ্রমিকের অভাব।


নেই কাঁচামালসহ গার্মেন্টস পণ্য তৈরির প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও। তাই নেত্রকোনার বাড়ির কারখানায় শুধু স্যুইংয়ের কাজ করান। আর ফিনিশং করান ঢাকার কুড়িল এলাকায়। এ জন্য কুড়িল বিশ^রোড এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে একটি ফিনিশিং সেন্টারও স্থাপন করেছেন তিনি। লিপি নিজেই ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তার কারখানায় এখন শপিংব্যাগ, চটের ব্যাগ, গেবাডিন প্যান্ট, জিন্স প্যান্ট, টিশার্ট, ট্রাউজার, মাস্ক ছাড়াও আরও কয়েক ধরনের পণ্য তৈরি হয়।

দেশে ছাড়াও যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ভারত, দুবাই, ইতালিসহ আরও কয়েকটি দেশে সরবরাহ হয় তার উৎপাদিত পণ্য। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় তার। ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার পণ্য সবসময় তার মজুদ থাকে। এরবাইরেও বেশকিছু সম্পদ করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে আরও ৭৭ শতক জমি কিনেছেন। ৩১ শতক জমিতে পুকুর দিয়ে করছেন মাছ চাষ। তার কারখানায় আছে ৫০টি সেলাই মেশিন ছাড়াও গার্মেন্টস কাজের অসংখ্য যন্ত্রপাতি।

সাফল্যের স্বীকৃতি
বলা হয়ে থাকে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। লিপির জীবনে যেন তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত। ২০১৪ সালে অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে ‘দেশসেরা জয়িতা পুরস্কার’ পান লিপি। এর আগে তিনি ঢাকা বিভাগেও শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পান। ২০২০ সালে তিনি অর্জন করেন কলকাতা-বাংলাদেশ মৈত্রী পুরস্কার।

২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রবর্তিত ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয় লিপিকে। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী এবং স্বপ্নসফল এ নারী।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর