• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পোশাক ।। পাঞ্চি পারহান ও পাঞ্চি ধুতি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০২৩  

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সমতলে বসবাস করা সাঁওতালসহ ক্ষুদ্র বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর পোশাকে ঐতিহ্যের পাশাপাশি লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বনে-জঙ্গলে শিকার করে দিন কাটানো এই জনগোষ্ঠী এখন অনেকটাই বদলে ফেলেছে তাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি। চাষাবাদের পাশাপাশি এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধেক মানুষই বর্তমানে লেখাপড়া শিখে চাকরি করছেন। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার প্রধান অনুষঙ্গ পোশাকে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তবে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে তারা ধরে রেখেছেন নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘পাঞ্চি পারহান’ ও পুরুষদের ‘পাঞ্চি ধুতি’ পরার প্রচলন। ‘পাঞ্চি পারহান’ ও ‘পাঞ্চি ধুতি’ পরে নারী-পুরুষ মিলিতভাবে নাচের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তারা তির-ধনুক হাতে নিয়ে। বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি-ধুতিকে দুই খ- করে পরিধান করেন এখানকার আদিবাসীরা। 
গাইবান্ধা জেলার সাত উপজেলার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস শুধু গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমি এলাকার ছয়টি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে প্রাচীনকাল থেকে বাস করছেন তারা। সাঁওতাল, ওরাও, মাহালী ও পাহাড়ি নামের চারটি সম্প্রদায়ের ছয়-সাত হাজার মানুষ বসবাস করেন রাজাবিরাট, জয়পুর, মাদারপুর, তুলটসহ বিভিন্ন গ্রামে। 
ব্রিটিশ শাসনামল থেকে মিশনারীদের কারণে অবহেলিত ও দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃতিপূজারী এই জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষা ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের ফলে তাদের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন আসলেও তারা ভোলেননি তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। শিক্ষা ও চাকরির কারণে দৈনন্দিন পোশাক ও জীবনাচরণে আধুনিকতার ছাপ পড়লেও নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে তারা ঐতিহ্য মেনে চলেছেন আজও। একদার আকাশ-সূর্য, পাহাড়-বৃক্ষকে দেবতা মানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের অর্ধেক মানুষই বর্তমানে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর লেখাপড়া শিখে উন্নত জীবনযাপন করছেন। তবে নিজেদের মাতৃভাষার হরফ, বই-পুস্তক ও শিক্ষক না থাকায় নিজস্ব ঐতিহ্য রক্ষায় বেশ সমস্যায় পড়েছেন তারা। কেবল উৎসব-পার্বণেই তারা পরিধান করেন তাদের নিজস্ব পোশাক। 
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা, কাটাবাড়ি, রাজাহার, শাখাহার, বিরাট ও কামদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বর্তমানে ছয় থেকে সাতহাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন। মূলত কৃষিজীবী সাঁওতাল, ওরাও, মাহালী ও পাহাড়ি নামের চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে বেশি। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় সাঁওতালদের অধিকাংশই বর্তমানে খ্রিস্টানধর্মের অনুসারী। সামান্যসংখ্যক কিছু সাঁওতাল সনাতন ধর্মে থেকে গেলেও ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হওয়া ওরাও, মাহালী ও পাহাড়ি সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকজন এখনো সনাতন ধর্মের বিধান মেনে চলেন। 
তবে উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রায় সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। এ সময় তারা একে অপরের ধর্মীয়সহ সকল উৎসবে যোগ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে এখানে খ্রিস্টান ও নন্খ্রিস্টান এ দুটি ভাগ দেখা গেলেও প্রাচীনকালের রীতি মেনে সনাতনি দুর্গা বা মনসা পূজার পাশাপাশি খ্রিস্টীয় বড়দিনের উৎসব এবং ঐতিহ্যবাহী সোহরায় অথবা বাহা উৎসবও মহাসমারোহে পালিত হয় এই জনগোষ্ঠীর মাঝে। এ সব অনুষ্ঠানে নারীরা পড়ে থাকেন রং-বেরঙের দুই খ- শাড়িতে তৈরি বিশেষ পোশাক ‘পাঞ্চি পারহান’। পুরুষরা ঢোল-মাদল নিয়ে নাচে যোগ দেন ‘পাঞ্চি ধুতি’ পরে।

মিশনারী, আদিবাসী নেত্রী ও সমাজসেবক এমিলি হেমব্রম জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমানে এ উপজেলাসহ পাশর্^বর্তী দিনাজপুরের কয়েকটি অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের শতকরা ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ মানুষ শিক্ষিত হয়ে সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে চাকরি করছেন। তাঁরা এ দেশীয় বাঙালি সংস্কৃতি ও পোশাকের পাশাপাশি ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও পোশাকে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আদিবাসী সমাজের ঐতিহ্য কেউ ভোলেননি। শিকড়ের টান বজায় রাখতে তারা এখনো ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য। 
গোবিন্দগঞ্জের আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কে জনকণ্ঠকে বলেন, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্য কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে এখন। এখানকার চারটি সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করেন মিলিতভাবে। ঐতিহ্য রক্ষায় এখানে বিভিন্ন পার্বণ, বিয়ে, বাহা পরব, সোহরাই পরব, কারাম উৎসব, বড়দিন, দুর্গা পূজা, মনসা পূজা উদযাপিত হয় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। এ জন্যে দুই খ- কাপড়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বা ধুতি ‘পাঞ্চি পারহান’ ও ‘পাঞ্চি ধুতি’ পরে নারী-পুরুষ মিলিত হয়ে ঢোল-মাদলের হৃদয় দোলানো, নেশা ধরানো আনন্দের বোল তুলতে এখনো কোনো কমতি নেই এ জনপদের আদিবাসীদের। 
আদিবাসী অধিকার কর্মী প্রিসিলা মুর্মু সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও পোশাক হারিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে বলেন, সারিভাষা নামের সাঁওতালী ভাষার স্বীকৃতি, ভাষার হরফ, লিখিত বর্ণমালা, বই ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক না থাকায় বাংলায় লেখাপড়া শিখে আমাদের সন্তানরা এখন বাঙালি পরিচয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী পোশাক ছেড়ে বাঙালি পোশাকে ঝুঁকে পড়ছে। 
গোবিন্দগঞ্জের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অবলম্বন’ এর নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী ও গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির তনু জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সূচকে আদিবাসীদের অনেকটাই উন্নয়ন হয়েছে। তবে বাঙালি নারীরা শাড়ি ছেড়ে অন্য পোশাকে ঝুঁকলেও আদিবাসী নারীরা শাড়ির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। 

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর