• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক জামালপুর

এখন শুধুই স্মৃতি বিয়ের ঐতিহ্য পালকি

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২৩  

একটা সময় বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনে পরিবহনের যান মানেই ছিল পালকি। নরসিংদীর বেলাবতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় একটি যান ছিল মানুষের। আরামদায়ক এ বাহনে চড়া একটা বিশেষ অনুভূতির তৈরি করতো। 
গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিয়ে বাড়ির সেরা আকর্ষণ ছিল এ পালকি। বিয়ের উৎসবে পালকির কদর ছিল সর্বাধিক। তখন বিয়ে মানেই পালকি ছিল একটা প্রধান উপকরণ। গ্রামীণ আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে, কখনও আলপথে বর-কনে পালকি চড়ে উভয়ের শ্বশুর বাড়িতে আসা-যাওয়ার আনন্দঘন একটা দারুণ সময় ছিল। 

গ্রামের পথে পালকিতে করে নববধূকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে মন জুড়াত গাঁওয়ের বধূ, মা-চাচি, দাদা-দাদি, নানা-নানি উঠতি বয়সের চঞ্চল যুবক-যুবতী এমনকি বাদ পড়েনি কিশোর-কিশোরীরাও।

ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-পড়শীসহ আপন জনদের বিয়েতে এটি ছিল প্রাচীন ও জনপ্রিয় বিবাহের পরিবহন। তাছাড়া স্বনামধন্য ও বিশিষ্ট্য ব্যক্তিকে অনেক সময় সম্মান দিয়ে এলাকাবাসী পালকিতে চড়িয়ে এলাকায় আলতো। পালকির বাহকদের সুমধুর স্বর ‘হু হুম না, হু হুম না’ আর শোনা যায় না, দেখা যায় না চমৎকারভাবে সুসজ্জিত পালকিগুলোও। 

পরবর্তীতে শিশুদের পাঠ্য বইয়ে সেই পালকি বিষয়ক গল্প, কবিতা দেওয়া হয়। সেগুলো ও অনেক আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। উধাও হয়ে গেছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা আমাদের অতি প্রিয় কবিতা ‘পালকির গান’। ‘হুম না, হুম না’ বলে মাঠ কাঁপিয়ে পালকির সে গানও আজ বিস্মৃত! অনভ্যাসে পালকি বাহকেরাও সম্ভবত ভুলতে বসেছেন তাদের নিজস্ব ঘরানার সে গানের কথা ও সুর। স্মৃতিতে কখনও সখনও সে গানের সুর জেগে উঠলেও যান্ত্রিকতায় আবার মিলিয়ে যায়। 

কেননা, পালকির প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে আজ কেবল রয়ে গেছে স্মৃতি। পালকি বাহকরাও আর নেই। আগে এলাকার বহু পরিবারের এক বা একাধিক পুরুষ পালকি বাহকের কাজ করতেন। তাদের অন্যতম প্রধান জীবিকাই ছিল পালকির বাহন। সময়ের দাপটে আজ পালকি অবলুপ্ত প্রায়। কালেভদ্রেও এখন পালকি বহনের ডাক আসে না। জীবিকা হারিয়ে পালকি বাহকেরা দীর্ঘদিন দিনমজুরি করেছেন।

৬৫ বছরের পালকি বাহক পরিবারের সুশেন দাস বলেন, ‘এই সেদিনও পালকির বায়না করতে দূর-দূরান্তে মানুষজন গ্রামে ঢুকেই জিজ্ঞেস করতো অমুক জায়গায় পালকি নিয়ে যাবেন দাদা? একটা বিয়ে ছিল। অথবা বলতেন সাহেবকে নিয়ে গ্রামে যাবেন দাদা? আজ কত করুণ কাটছে আমাদের দিন। আমরা এ গ্রামের বেশ অনেকজন পালকি বাহক ছিলাম। তখন আমাদের এমন ছিল না দিন। 

তিনি বলেন, মূলত অর্থাভাবের জন্য বাহকদের নিজস্ব কোনো পালকি ছিল না। কিন্তু বিয়ে, দ্বিরাগমন, গঙ্গা স্নান, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়া আসার জন্য বায়না তো বটেই রাত-বিরিতে ওঝা, কবিরাজ কিংবা হাসপাতাল যাওয়ার জন্য ডাক আসত আমাদের কাছে। আমরা সেইমতো পালকি মালিকেরও বায়না করতাম। গ্রামেই সে সময় ৮-১০ টি পালকি ছিল। বাইরের গ্রাম থেকেও পালকি ভাড়া আনা হতো। জমিদারবাড়ির নিজস্ব পালকি বহনের জন্যও ডাক পড়তো।’

কেমন রোজগার হত? প্রশ্ন শুনে স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন ৬২ বছরের সুধীর দাস, ৬৫ বছরের ভুবন সুত্রধরেরা। 

‘একটি পালকি মূলত ৬ জন বাহক বা বেহারা প্রয়োজন। কিন্তু একটানা বহন থেকে কিছুটা বিশ্রাম পেতে অতিরিক্ত আরো দু’জনকে রাখা হতো। আর থাকতেন একজন সর্দার। বায়না ধরা, সেই অনুযায়ী পালকি বায়না করা-সহ দলের বিবাদ-বিসংবাদ মীমাংসার গুরু দায়িত্ব পালন করতে হতো সর্দারকে। দূরত্ব অনুযায়ী পারিশ্রমিক মিলতো তখনকার দিনেই ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। কাছে পিঠে হলে একই দিনে একধিক ভাড়া খাটাও যেতো। পালকি মালিককে প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য ২০-৩০ টাকা। ভাড়া দিয়ে যা থাকত বন্টন করে তা দিয়েই কোনো রকমে দিনকাল চলে যেতো । তবে তাদের স্মৃতিরোমন্থনে বুঝা যায় অদ্ভূত এক ভালোলাগা ছিল এ পেশায়।

সেই ভালোলাগার টানেই এত কম আয়ের পেশার প্রতি এখনও টান! বলছিলেনও সে কথা। শুধু আয়ই নয়, এই পেশায় তেমন কোনো সম্মানও নেই। বহু ক্ষেত্রে গোয়ালঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। খাওয়া জুটেছে সবার শেষে। 

তাদের কথায়, ‘তবু বিয়ের মরসুম এলেই মন কেমন করে। আসলে বাপ ঠাকুর্দার পেশা যেন আজও আমাদের রক্তে মিশে রয়েছে। নেশার মতো হাতছানি দেয় পালকি। এ যেন মেলায় মেলায় ঘোরা সেইসব দোকানদারদের নেশার মতো। বিক্রি বাটা কিংবা লাভ হোক বা নাই হোক মেলায় দোকান দেওয়া চাই। আর দিনান্তে পিকনিকের মেজাজে হাড়িতে চালডাল ফুটিয়ে মৌজ করে খাওয়া।’

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর